top of page

Search Results

26 results found with an empty search

Blog Posts (23)

  • সেন্ট ভ্যালেন্টাইন বা সান ভালেন্তিনো এবং প্রেম দিবস।

    প্রাচীন রোমের লুপারকালিয়া : লুপারকালিয়া কালের অতলে, যখন রোম ছিল দেবতা ও রাজাদের নগরী, তখন জন্ম নিয়েছিল এক আশ্চর্য উৎসব— ‘ লুপারকালিয়া ’। প্রতি বছর ১৩ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি, রোমান তরুণরা ছুটে বেরোত নগরের পথে, হাতে থাকত বলিদান দেওয়া ছাগলের চামড়া। সেই চামড়া দিয়ে তারা ছুঁয়ে দিত পছন্দের নারীদের, বিশ্বাস করত— এ ছোঁয়া নারীর গর্ভকে উর্বর করবে। এই উৎসবের প্রতীকি রঙ ছিল লাল । লাল মানে রক্ত— রক্ত মানে নতুন প্রাণের প্রতিশ্রুতি। দেবতা লুপারকাস বা ফাউনাস, যিনি ছিলেন প্রকৃতির রক্ষক, তিনিই ছিলেন এই উৎসবের কেন্দ্র। উৎসব চলাকালীন বলিদানের ছাগল ও কুকুরের রক্ত দিয়ে রাঙ্গানো হত তরুণদের কপাল, আর নগরী বয়ে যেত বাঁধভাঙা উল্লাসে। কিন্তু ক্রমেই এই উৎসবের পেছনে জমছিল কালো মেঘ, যা কালের স্রোতে ভয়ঙ্কর ঝড়ের রূপে নিজেকে প্রস্তুত করছিল। রোমে প্রেম ভালোবাসা নিষিদ্ধ হল । The Roman Emperor Claudius সম্রাট ক্লডিয়াস  -এর কঠোর শাসনে রোম যখন বাঁধা পড়ল, তখন প্রেমের মন্দিরে জমল কালো মেঘ। তিনি ঘোষণা করলেন, সাম্রাজ্যের যুব শক্তি যদি প্রেম-ভালোবাসা বা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়, তবে তারা যুদ্ধে দুর্বল হয়ে পড়বে। তাই রোমে ভালোবাসার শপথ, মিলনের প্রতিশ্রুতি সবটাই নিষিদ্ধ হল।  সম্রাটের আদেশ অমান্য করে কার সাধ্য ! কিন্তু এক তরুণ বিদ্রোহ করে বসলেন, সে সম্রাটের এহেন আদেশ মানতে নারাজ। তিনি ছিলেন সেন্ট ভ্যালেন্টাইন, এক খ্রিস্টান পুরোহিত। প্রেমের প্রতিশ্রুতির সামনে শাসকের নিষেধাজ্ঞা তাঁর কাছে ছিল তুচ্ছ। তিনি গোপনে বিবাহ দিতে শুরু করলেন প্রেমিকযুগলকে, প্রেমের পবিত্র বন্ধনে প্রেমিক যুগলকে বেঁধে দেওয়াই যেন তার জীবনের ব্রত হয়ে দাঁড়াল। সত্য চিরকাল গোপন থাকে না। Saint Valentine ভ্যালেন্টাইন বন্দি হলেন, সম্রাটের আদেশে মৃত্যুদন্ড ধার্য হল তার। ২৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি, ভালোবাসার সেই যাজক রক্ত দিয়ে লিখলেন প্রেমের শেষ কবিতা। শোনা যায় মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর প্রিয়াকে লিখেছিলেন এক চিঠি, যার শেষে লেখা ছিল— "তোমার ভ্যালেন্টাইন"। ভালোবাসা যার হৃদয়ে, তাকে কি শাস্তি দিয়ে মুছে ফেলা যায়?  পোপ গেলাসিয়াস সময় এগিয়ে এলো ৪৯৬ খ্রিস্টাব্দ।  পোপ গেলাসিয়াস  I তিনি ঘোষণা করলেন, "লুপারকালিয়া পাপাচার, অনৈতিক। একে বিলুপ্ত করতে হবে!" বদলে তিনি ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন দিবস’ হিসেবে ভালোবাসার নামে উৎসর্গ করা হয় এই দিন। ‘রক্তের উৎসব আর নয়’ বলেও ফতোয়া জারি হল। ১৪শ শতকের কবি জিওফ্রে চসার তাঁর কাব্যে বললেন—"১৪ ফেব্রুয়ারি, এই দিনে পাখিরা জোড়া বাঁধে, হৃদয়ে প্রেম জাগে।" এভাবেই কবিতায়, গদ্যে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের নাম ইতিহাসে লেখা হয়ে গেল প্রেমের প্রতিবিম্ব রূপে। ক্রমে শুভেচ্ছা বিনিময়ের রীতি শুরু হলো, ভালোবাসার মানুষকে লেখা হলো প্রথম "ভ্যালেন্টাইন কার্ড"। ভালোবাসার শরীরে লাগল বাণিজ্যের ছোঁয়া। Valentine Day Celebration ১৮শ -১৯শ শতকে, হাতে লেখা ভালোবাসার চিঠির জায়গা নিল ছাপানো কার্ড। ২০শ শতকে, ভালোবাসার প্রতীক হয়ে উঠল চকোলেট, গোলাপ, হীরের আংটি। ভালোবাসায় ক্রমে বানিজ্যের রঙ লাগল, বিভিন্ন ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান সুযোগ বুঝে শুরু করল বাণিজ্যের নতুন খেলা— "ভালোবাসা প্রকাশ করতে চাইলে উপহার দাও!" ফলস্বরূপ ভ্যালেন্টাইনস ডে  মানে বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি গোলাপ বিক্রি, চকোলেটের পাহাড়, দামি উপহার আর বিলাসবহুল রেস্তোরাঁয় রাতের খাবার। আজকের দিনে মনের মানুষটির সাথে ভালোবাসায় ভেলায় ভেসে যাওয়ার আগে একবার মনে করে নেবেন ভালোবাসা দিবসের এই ইতিহাস; যার প্রতিটা ইটে প্রাচীন রোমের লুপারকালিয়া উৎসব থেকে শুরু করে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের আত্মত্যাগ, সবটা আজও মিশে আছে।

  • মামলেটের জন্মকথা।

    দিন বদলের সাথে সাথে কলকাতার ফুটপাতে চাইনিজ, কোরিয়ান, নেপালী, টিবেটিয়ান ক্যুইজিন জায়গা করে নিয়েছে। তবে বাংলার বুকে সময় আর প্রজন্ম যতই বদলাক, বাঙালি রসনায় বা স্ট্রিট ফুড হিসেবে সবচেয়ে বেশি বিক্রিতে ডিম টোস্ট বা মামলেটের জুড়ি নেই। এই ডিম টোস্টকে কলকাতার ফুটপাতে ফ্রেঞ্চ টোস্ট নামেও বিক্রির চল রয়েছে। যদিও এই খাবারের সঙ্গে ফ্রান্সের কোনো সম্পর্কই নেই। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, হঠাৎ আমাদের চায়ের ঠেকের বা মা-কাকিমার রান্নাঘরের ডিম পাউরুটিকে ফ্রান্সের সঙ্গে জোড়া হয়েছে কেন? ঠিক এরই জন্য ওমলেটের আতুঁর ঘরে পৌঁছতে হবে। জানা যায় ইউরোপিয়ানরাই প্রথম ডিম ভাজা করে খাওয়ার পথ প্রদর্শন করেন।  French Omelette ইউরোপীয় দেশ ফ্রান্স ডিম ফেটিয়ে তাতে মাংস সিদ্ধ, চিজ, টমেটো,ক্যাপসিকাম বা হ্যাম ব্যবহার করে; সাথে সামান্য ময়দা গুলে প্যানে মিশ্রনটিকে শুইয়ে ধীমে আঁচে মহার্ঘ্য যে বস্তুটি তৈরী হয়, সেটাই ওমলেট। ইতিহাস বলছে, ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট সেনাবাহিনী-সহ দক্ষিণ ফ্রান্স দিয়ে যাত্রা করার সময় বেসিয়েরেসের কাছে এক সরাইখানায় জীবনে প্রথম এই পুরু ও সুস্বাদু ওমলেট খেয়েছিলেন। তৃপ্তি সহকারে ওমলেট পেটে চালান করেই সম্রাট আদেশ করলেন, গ্রামের সব বাড়ি থেকে ডিম সংগ্ৰহ করে তাঁর সেনাবাহিনীর জন্য বিশাল আকারের ওমলেট তৈরি করতে হবে। ইতিহাস সাক্ষী রেখে সে দীর্ঘ ওমলেট তৈরিও হল। তারপর থেকেই ফ্রান্সে ইস্টারে দীর্ঘ ওমলেট খাওয়ার ট্রাডিশন শুরু হয়! এখনও পর্যন্ত বেসিয়েরেস সেই ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। ইস্টার সানডেতে তারা ১৫ হাজার ডিম দিয়ে বানায় বিশাল আকৃতির ওমলেট । কয়েকশো মানুষ এই উৎসবে রান্নায় দায়িত্বে থাকেন। আর উৎসবে অংশ নেওয়া মানুষেরা বিশাল ওমলেটের খানিকটা অংশ পাওয়ার অপেক্ষায় থাকেন। এছাড়া বেলজিয়ামেও এই উৎসবের আয়োজন হয়। ওমলেটটি সুস্বাদু করতে লবণ, তেল, বাটার, দুধ, চিলি ফ্লেক্স, গোল মরিচ ইত্যাদি অনেক কিছুই ব্যবহার করা হয়। এত এত জিনিসের আয়োজন দেখে মনে হবে এ যেন মহাভারতে পড়া কোনও কোনো মহাযজ্ঞ-এর প্রস্তুতি।    Giant Omelette Festival ফিরে আসি বাংলায়। যে বাঙালি একসময় কেবল ভাত-মাছেই তৃপ্তি পেত, সেই বাঙালির জিভ-ই বিংশ শতাব্দীর মাঝখান থেকে নানারকম প্রথাবিরোধী খাবারে মন দিয়েছে। গোটা ভারতে যখন হিন্দুদের মধ্যে ডিম নিয়ে নানা সংস্কার ছিল, তখন কিন্তু শহুরে বাঙালি এসব সংস্কারের ঊর্ধ্বেই থেকেছে। তবে শোনা যায় উচ্চবর্ণের হিন্দুরা হাঁসের ডিম খেলেও মুরগির ডিমে তাঁদের প্রবল আপত্তি ছিল। সময় যত গড়াতে থাকল, ইংরেজি শিক্ষার হাওয়ার বইতে শুরু করল বাঙালি হিন্দু পরিবারের অন্দরমহলে, সংস্কার নামক বস্তুটি ততই ক্রমশ দূর হতে শুরু করল। খাঁটি বৈষ্ণব এমনকি ব্রাহ্মণ বাড়ির জলখাবারে ঢুকতে শুরু করল ডিমের নানা পদ, তা সে ওমলেট হোক বা পোচ। পরে অবশ্য সর্বস্তরের বাঙালি মননে ডিম নিজের আসনটি পাকা করেছে নিজ গুণে। কারণ হিসেবে ‘পুষ্টিগুণে পরিপূর্ণ প্রোটিন জাতীয় খাদ্যের মধ্যে ডিমই সবচেয়ে সস্তা’ -এটিকেই প্রাধান্য দেওয়া হয় । ইওরোপিয়ান দের ডিমের সাদা অংশকে ফেটিয়ে তেল বা মাখনে ভেজে খাওয়ার রেওয়াজই ছিল ডিমের জন্মের উপপাদ্য।কিন্তু বাঙালির রান্নাঘরে ঢুকেই ডিম অন্যরূপ ধারণ করল। কড়াই বা তাওয়ায় ঝাঁঝালো সষের তেলে সাতার কাটার আগে ডিমের সঙ্গে মিশল পেঁয়াজের মিষ্টত্ব আর কাঁচালঙ্কার ঝাল, ওমলেট হল ‘মামলেট’। এই মামলেটের স্বাদ বাঙালি বংশ পরম্পরায় বহন করেছে পান্তা ভাত, গরম খিচুড়ি বা ডালভাতের অনুষঙ্গে। গরম ভাতের সঙ্গী 'মামলেট' এই কিছু বছর আগেও ল্যাম্পপোস্টের নিচে খদ্দেরদের ওমলেট ভেজে দেওয়ার জন্য ডিমের পসরা সাজিয়ে বসতেন কিছু মানুষ। একটা ছোট্ট উনুন, অ্যালুমিনিয়ামের সসপ্যান, মাথায় ফুটো করা এক বোতল সর্ষের তেল, স্টিলের গেলাস, খুন্তি, পেঁয়াজ কুঁচি, লঙ্কা আর নুনের বাটি নিয়ে তাঁরা বসতেন সন্ধের আঁধারে। সুনিপুণ কায়দায় গেলাসের কানায় ডিম ঠুকতেন, ভাঙা ডিমে চটপট মিশিয়ে নিতেন পেঁয়াজ কুচি, কাঁচালঙ্কা আর নুন। মনোনিবেশ করে খুন্তির পেছন দিয়ে ডিম গুলে নেওয়ার পর ডিম ভাজার পর্ব চলত। হাতের দক্ষতায় সসপ্যানে ফুলে ওঠা ডিম শূন্যে ডিগবাজি দিলেই মামলেট খদ্দেরের প্লেটে সস্নেহে পৌঁছে দিতেন বিক্রেতারা। Roadside Tea-Omlette stall এরপর শহরের মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তের রান্নাঘরে কড়াইয়ের বদলে ঢুকে পড়ল ননস্টিক প্যান। তাতে সর্ষের তেলের বদলে জুড়ে গেল রিফাইন তেল। ওমলেটের রূপ রং গেল বদলে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সেই বিক্রেতারাই মামলেটের সঙ্গে আমদানি করলেন পাউরুটি। দাম একটু বেশি পড়লেও ডিমটোস্টের জন্মলগ্ন থেকে পাশে থাকা সেইসব খদ্দের আজও মুখ ফেরায়নি।  বাঙালির জীবনে এখন যতই ফাইভস্টার হোটেলের ইতালিয়ান ওমলেট ফ্রিটাটা বা ফ্রায়েড এগের কদর কদর বাড়ুক, বাঙালি কিন্তু জানে ফ্রায়েড এগ মানেই তাদের সাধের মামলেট নয়। পাড়ার কালিদার চা দোকানে বসে ডিমটোস্ট কিংবা মোটা পুরুষ্ট ওমলেটের স্বাদ নিতে নিতে খবরের কাগজ ওল্টানোর মজাই আলাদা।  Egg Toast মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি রুগীর অসহায় পরিবার থেকে কলেজ স্ট্রিটে বই কিনতে আসা দূরের জেলার যুবক কিংবা মেসের বাসিন্দা অল্প মাইনে পাওয়া রোগা পাতলা ছাত্রের ভরসা এখনও ডিম সেদ্ধ, মামলেট, পোচ বা এগ টোস্ট। ধোঁয়া ওঠা চায়ের সঙ্গে ওমলেট, পোচ বা ডিমটোস্ট তাদের সুলভে প্রোটিনের নিরাপত্তার পাশাপাশি এই বড় শহরে হারিয়ে না যাওয়ার ভরসা জোগায়।

  • রেবা রক্ষিত : স্মৃতির অতলে থাকা সার্কাস সম্রাজ্ঞী

    শহর কলকাতায় শীত একটু একটু করে তার উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। বাঙালির শীতকাল মানেই বোরোলীন-পাটালী-কমলালেবু-পিকনিক-চিড়িয়াখানা আর সার্কাস! সার্কাস বলতেই মনে পড়ে ছিপছিপে বিদেশী তরুনীর দল আর জন্তু-জানোয়ার নিয়ে অদ্ভুত সব খেলা। কিন্তু যদি বলি এমন বাঙালী রমনী বিস্তৃতির অতলে আছেন, যিনি স্বাধীনতারও আগে হয়ে উঠেছিলেন সার্কাসের আইকন- শুনবেন তার গল্প ? ১৯৩০ সালে অবিভক্ত বাংলার কুমিল্লায় ‘অনিমা রক্ষিত’-এর জন্ম। স্কুলে যখন পড়তেন, সেই সময়েই কুমিল্লা থেকে কলকাতায় এসে ওঠে তাঁর পরিবার। খেলাধুলো, শরীরচর্চা, দৌড়, সাঁতার কাটা, গাছে চড়া ইত্যাদি কাজে-কর্মে তাঁর অফুরান উৎসাহ ছিল সেই ছোটোবেলা থেকেই। বাড়ির অমতেই একপ্রকার জেদ ধরে কলকাতায় জাতীয় ‘ক্রীড়া ও শক্তি সংঘ’ নামের একটি যোগচর্চা কেন্দ্রে ভর্তি হন অনিমা। ওই ছোট বয়সেই এই সংঘের কর্ণধার শম্ভু মল্লিকের সঙ্গে নানা জায়গায় ক্যাম্পে উপস্থিত থাকতেন তিনি। এগারো বছর বয়সে পুরোপুরি শরীরচর্চায় মনোনিবেশ করার জন্য শম্ভু মল্লিকের সংঘ থেকে রেবা রক্ষিত চলে আসেন বিষ্টু ঘোষের কুস্তির আখড়ায়। তাঁর কাছে আসন আর যোগাভ্যাসের পাঠ নেন; একই সময়ে বিষ্ণুচরণ ঘোষের কাছে পেশি ও শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণের খেলা শিখে নেন তিনি। সেই সময়েই যোগাভ্যাসের পাশাপাশি প্রাণায়ামের পাঠও রপ্ত করেছিলেন। অনিমার আগ্রহ ও উৎসাহ দেখে বিষ্টু ঘোষ নিজেই এক সার্কাসের মালিকের সঙ্গে কথা বলে শোয়ের বন্দোবস্ত করে দেন। সার্কাসের জগতে এসে অনিমা রক্ষিত হয়ে গেলেন ‘রেবা রক্ষিত’ সেই শুরু হল রেবার পথচলা।  স্বাধীনতার দুই বছর আগে, সার্কাসের একটা ম্যাটিনি শো-তে বুকের উপর দিয়ে মোটর সাইকেল চালিয়ে এক দুঃসাহসিক নজির তৈরি করেছিলেন রেবা রক্ষিত।বুকের উপর মোটরসাইকেল উঠিয়ে দেওয়ার এই মারণ খেলা তাঁকে ক্রমে আরও জনপ্রিয়তা দিলো। শুনলে আশ্চর্য হতে হয়, তাঁর বয়স তখন মাত্র পনেরো-ষোলো বছর। নির্ভীক এই বঙ্গমহিলার কাণ্ড দেখে দর্শকরা ভয়ে চোখ বুজে ফেলতেন সেই সময় আর সেটাই ছিল তাঁর শোয়ের বিশেষত্ব।  এমনই এক সন্ধ্যায় ঘটল দুর্ঘটনা।  দর্শক আসন তখন কানায় কানায় পূর্ণ। রেবা রক্ষিত মঞ্চে টানটান শুয়ে তৈরি। আর তারপরেই বাইকের ভারী সামনের চাকাটা চলে গেল তার উপর দিয়ে রোজকার মতই। কিন্তু রেবা টের পাননি, বিপদ সেদিন তার পিছু নিয়েছিল। পিছনের চাকাটা ওঠার পরেই মুখের কাছে প্রচণ্ড জোরে আঘাত পান রেবা, চোখে মুখে তখন অন্ধকার দেখছেন। গালে বসে গেল টায়ারের কালো দাগ। টানা দু মাস দগদগে ছিল সেই দাগ। সেই দুর্ঘটনায় রেবার প্রাণসংশয় হলেও রেবা ফিরে এলেন। দমে যাওয়ার পাত্রী তিনি নন, তবে মোটর সাইকেলের খেলাকে এবার বিদায় জানানোর পালা। মোটর সাইকেলের পরে এবার শুরু হল বুকে হাতি তোলার খেলা।  তখন পঞ্চাশের দশক। সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া দেশে তখন সাড়া ফেলেছিল প্রিয়নাথ বসুর গ্রেট বেঙ্গল সার্কাসের দারুণ সব খেলা। শুধু তাই নয়, প্রিয়নাথ বসুর অনুসরণে আরও বেশ কিছু সার্কাসের দল গড়ে উঠলো ভারতে। সমস্ত দেশ জুড়ে তখন এই সার্কাসগুলির মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে নিত্য নতুন খেলা দেখানোর।  ট্রায়াল শো-তে পঞ্চাশ-ষাট মণ ওজনের বাচ্চা হাতি রেবা অনায়াসে বুকে তুলে নিলেন। অবশেষে চূড়ান্ত শো, পূর্ণবয়স্ক একটি হাতি সেদিন অনায়াসে রেবার বুকের উপর দিয়ে হেঁটে চলে যায়, রেবা তখনও অক্ষত এবং প্রাণোচ্ছ্বল। এরপরই নানা সার্কাস থেকে ডাক আসতে থাকলো। রেবা ক্রমান্বয়ে দেখাতে শুরু করলেন তাঁর হাতির খেলা। শো-পিছু উপার্জনও হতে লাগলো ভালোই। সেকালের হিসেবে শনিবার কিংবা রবিবারের প্রতি শো-পিছু ২০০ থেকে ২৫০ টাকা উপার্জন করতেন রেবা। এই খেলাই সমগ্র ভারতে তাঁকে সার্কাসের সম্রাজ্ঞী বানিয়ে তুলেছিল। গ্রেট বম্বে সার্কাসে টানা আট বছর এই হাতির খেলা দেখিয়েছেন তিনি।   বুকের উপর পেতে রাখা কাঠের তক্তা দিয়ে হাতি হেঁটে চলে যেত। রেবা নির্বিকার শুয়ে থাকতেন, পরে কাঠের তক্তা সরানো হলে উঠে আসতেন হাসিমুখে। ইন্টারন্যাশনাল সার্কাসের হয়ে শেষবারের মতো খেলা দেখিয়েছিলেন এই বাঙালি কন্যা। ১৯৫৫ সালে ‘মিস বেঙ্গল’ হন রেবা, ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত করে। সুদূর আমেরিকার Ida Jo Pajunen সম্প্রতি রেবা’কে নিয়ে লিখেছেন Strong Woman Reba Rakshit: The Life and Adventures of a Stuntmaster.   তবে বাঙালির স্মৃতির পাতায় ‘রেবা রক্ষিত’ অনুজ্জ্বল এক ক্ষীণ জ্যোতিষ্কের মতোই অনালোচিত থেকে গিয়েছেন আজও।    রেবা রক্ষিত কেন বিশেষ: হাতির মতো ভারী প্রাণীকে বুকে তুলে ধরে রাখার জন্য অসাধারণ শারীরিক শক্তির প্রয়োজন। রেবা অবশ্যই সেই শক্তির অধিকারী ছিলেন। তবে শুধু শক্তি বা শারীরিক ক্ষমতা নয়, রেবা রক্ষিত হওয়ার জন্য এই 2024-এও প্রচুর সাহসের প্রয়োজন। আজকের দিনে যখন আমরা নারীশক্তির কথা বলি, তখন রেবা রক্ষিতের মতো মেয়েদের মনে রাখা জরুরি। রেবা সেই কবে দেখিয়ে গিয়েছেন - একজন নারী যদি চায়, তাহলে সে সব কিছু করতে পারে।  আজ এই লেখা পড়ে সুকুমার রায়ের লেখা ‘পালোয়ান’ নামের ছড়ার সেই বিখ্যাত পঙ্‌ক্তি - ‘খেলার ছলে ষষ্ঠীচরণ, হাতি লোফেন যখন তখন / দেহের ওজন উনিশটি মণ, শক্ত যেন লোহার গঠন’ শুনে বা পড়ে আপনার মনে যদি গোফওয়ালা কোনও পালোয়ান পুরুষ এর পাশাপাশি পঞ্চাশের দশকের কোনও বাঙালি রমনীর অবয়ব মনে পড়ে তাহলেই এই লেখা সার্থক।

View All
bottom of page