মামলেটের জন্মকথা।
- Piyali Debnath

- Dec 10, 2024
- 3 min read
দিন বদলের সাথে সাথে কলকাতার ফুটপাতে চাইনিজ, কোরিয়ান, নেপালী, টিবেটিয়ান ক্যুইজিন জায়গা করে নিয়েছে। তবে বাংলার বুকে সময় আর প্রজন্ম যতই বদলাক, বাঙালি রসনায় বা স্ট্রিট ফুড হিসেবে সবচেয়ে বেশি বিক্রিতে ডিম টোস্ট বা মামলেটের জুড়ি নেই। এই ডিম টোস্টকে কলকাতার ফুটপাতে ফ্রেঞ্চ টোস্ট নামেও বিক্রির চল রয়েছে। যদিও এই খাবারের সঙ্গে ফ্রান্সের কোনো সম্পর্কই নেই। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, হঠাৎ আমাদের চায়ের ঠেকের বা মা-কাকিমার রান্নাঘরের ডিম পাউরুটিকে ফ্রান্সের সঙ্গে জোড়া হয়েছে কেন? ঠিক এরই জন্য ওমলেটের আতুঁর ঘরে পৌঁছতে হবে। জানা যায় ইউরোপিয়ানরাই প্রথম ডিম ভাজা করে খাওয়ার পথ প্রদর্শন করেন।

ইউরোপীয় দেশ ফ্রান্স ডিম ফেটিয়ে তাতে মাংস সিদ্ধ, চিজ, টমেটো,ক্যাপসিকাম বা হ্যাম ব্যবহার করে; সাথে সামান্য ময়দা গুলে প্যানে মিশ্রনটিকে শুইয়ে ধীমে আঁচে মহার্ঘ্য যে বস্তুটি তৈরী হয়, সেটাই ওমলেট। ইতিহাস বলছে, ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট সেনাবাহিনী-সহ দক্ষিণ ফ্রান্স দিয়ে যাত্রা করার সময় বেসিয়েরেসের কাছে এক সরাইখানায় জীবনে প্রথম এই পুরু ও সুস্বাদু ওমলেট খেয়েছিলেন। তৃপ্তি সহকারে ওমলেট পেটে চালান করেই সম্রাট আদেশ করলেন, গ্রামের সব বাড়ি থেকে ডিম সংগ্ৰহ করে তাঁর সেনাবাহিনীর জন্য বিশাল আকারের ওমলেট তৈরি করতে হবে। ইতিহাস সাক্ষী রেখে সে দীর্ঘ ওমলেট তৈরিও হল। তারপর থেকেই ফ্রান্সে ইস্টারে দীর্ঘ ওমলেট খাওয়ার ট্রাডিশন শুরু হয়! এখনও পর্যন্ত বেসিয়েরেস সেই ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। ইস্টার সানডেতে তারা ১৫ হাজার ডিম দিয়ে বানায় বিশাল আকৃতির ওমলেট। কয়েকশো মানুষ এই উৎসবে রান্নায় দায়িত্বে থাকেন। আর উৎসবে অংশ নেওয়া মানুষেরা বিশাল ওমলেটের খানিকটা অংশ পাওয়ার অপেক্ষায় থাকেন। এছাড়া বেলজিয়ামেও এই উৎসবের আয়োজন হয়। ওমলেটটি সুস্বাদু করতে লবণ, তেল, বাটার, দুধ, চিলি ফ্লেক্স, গোল মরিচ ইত্যাদি অনেক কিছুই ব্যবহার করা হয়। এত এত জিনিসের আয়োজন দেখে মনে হবে এ যেন মহাভারতে পড়া কোনও কোনো মহাযজ্ঞ-এর প্রস্তুতি।

ফিরে আসি বাংলায়। যে বাঙালি একসময় কেবল ভাত-মাছেই তৃপ্তি পেত, সেই বাঙালির জিভ-ই বিংশ শতাব্দীর মাঝখান থেকে নানারকম প্রথাবিরোধী খাবারে মন দিয়েছে। গোটা ভারতে যখন হিন্দুদের মধ্যে ডিম নিয়ে নানা সংস্কার ছিল, তখন কিন্তু শহুরে বাঙালি এসব সংস্কারের ঊর্ধ্বেই থেকেছে। তবে শোনা যায় উচ্চবর্ণের হিন্দুরা হাঁসের ডিম খেলেও মুরগির ডিমে তাঁদের প্রবল আপত্তি ছিল। সময় যত গড়াতে থাকল, ইংরেজি শিক্ষার হাওয়ার বইতে শুরু করল বাঙালি হিন্দু পরিবারের অন্দরমহলে, সংস্কার নামক বস্তুটি ততই ক্রমশ দূর হতে শুরু করল। খাঁটি বৈষ্ণব এমনকি ব্রাহ্মণ বাড়ির জলখাবারে ঢুকতে শুরু করল ডিমের নানা পদ, তা সে ওমলেট হোক বা পোচ। পরে অবশ্য সর্বস্তরের বাঙালি মননে ডিম নিজের আসনটি পাকা করেছে নিজ গুণে। কারণ হিসেবে ‘পুষ্টিগুণে পরিপূর্ণ প্রোটিন জাতীয় খাদ্যের মধ্যে ডিমই সবচেয়ে সস্তা’ -এটিকেই প্রাধান্য দেওয়া হয় । ইওরোপিয়ান দের ডিমের সাদা অংশকে ফেটিয়ে তেল বা মাখনে ভেজে খাওয়ার রেওয়াজই ছিল ডিমের জন্মের উপপাদ্য।কিন্তু বাঙালির রান্নাঘরে ঢুকেই ডিম অন্যরূপ ধারণ করল। কড়াই বা তাওয়ায় ঝাঁঝালো সষের তেলে সাতার কাটার আগে ডিমের সঙ্গে মিশল পেঁয়াজের মিষ্টত্ব আর কাঁচালঙ্কার ঝাল, ওমলেট হল ‘মামলেট’। এই মামলেটের স্বাদ বাঙালি বংশ পরম্পরায় বহন করেছে পান্তা ভাত, গরম খিচুড়ি বা ডালভাতের অনুষঙ্গে।

এই কিছু বছর আগেও ল্যাম্পপোস্টের নিচে খদ্দেরদের ওমলেট ভেজে দেওয়ার জন্য ডিমের পসরা সাজিয়ে বসতেন কিছু মানুষ। একটা ছোট্ট উনুন, অ্যালুমিনিয়ামের সসপ্যান, মাথায় ফুটো করা এক বোতল সর্ষের তেল, স্টিলের গেলাস, খুন্তি, পেঁয়াজ কুঁচি, লঙ্কা আর নুনের বাটি নিয়ে তাঁরা বসতেন সন্ধের আঁধারে। সুনিপুণ কায়দায় গেলাসের কানায় ডিম ঠুকতেন, ভাঙা ডিমে চটপট মিশিয়ে নিতেন পেঁয়াজ কুচি, কাঁচালঙ্কা আর নুন। মনোনিবেশ করে খুন্তির পেছন দিয়ে ডিম গুলে নেওয়ার পর ডিম ভাজার পর্ব চলত। হাতের দক্ষতায় সসপ্যানে ফুলে ওঠা ডিম শূন্যে ডিগবাজি দিলেই মামলেট খদ্দেরের প্লেটে সস্নেহে পৌঁছে দিতেন বিক্রেতারা।

এরপর শহরের মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তের রান্নাঘরে কড়াইয়ের বদলে ঢুকে পড়ল ননস্টিক প্যান। তাতে সর্ষের তেলের বদলে জুড়ে গেল রিফাইন তেল। ওমলেটের রূপ রং গেল বদলে।
প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সেই বিক্রেতারাই মামলেটের সঙ্গে আমদানি করলেন পাউরুটি। দাম একটু বেশি পড়লেও ডিমটোস্টের জন্মলগ্ন থেকে পাশে থাকা সেইসব খদ্দের আজও মুখ ফেরায়নি।
বাঙালির জীবনে এখন যতই ফাইভস্টার হোটেলের ইতালিয়ান ওমলেট ফ্রিটাটা বা ফ্রায়েড এগের কদর কদর বাড়ুক, বাঙালি কিন্তু জানে ফ্রায়েড এগ মানেই তাদের সাধের মামলেট নয়। পাড়ার কালিদার চা দোকানে বসে ডিমটোস্ট কিংবা মোটা পুরুষ্ট ওমলেটের স্বাদ নিতে নিতে খবরের কাগজ ওল্টানোর মজাই আলাদা।

মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি রুগীর অসহায় পরিবার থেকে কলেজ স্ট্রিটে বই কিনতে আসা দূরের জেলার যুবক কিংবা মেসের বাসিন্দা অল্প মাইনে পাওয়া রোগা পাতলা ছাত্রের ভরসা এখনও ডিম সেদ্ধ, মামলেট, পোচ বা এগ টোস্ট। ধোঁয়া ওঠা চায়ের সঙ্গে ওমলেট, পোচ বা ডিমটোস্ট তাদের সুলভে প্রোটিনের নিরাপত্তার পাশাপাশি এই বড় শহরে হারিয়ে না যাওয়ার ভরসা জোগায়।




_edited.jpg)
💌একটা খুব মনের মতো লেখা পড়লাম..অনেকদিন পর..আবার যেটা আমাকে উপহার দেওয়াI পিয়ালিদি❤️..
আমার একটা সময়ের সব কথা বলার মানুষ, আজও সুযোগ পেলে বলবো কারণ এমন মানুষ আমার জীবনে আর আসেনি I Thank you তোমাকে..🥰 এভাবেও মানুষ কে ভালোবেসে মনে রাখতে তুমিই পারো ..❤️❤️😘
ও বাবা! এর পরে কেউ মামলেট খেতে দিলে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে তো। দারুণ দারুণ। চালিয়ে যাও