রেবা রক্ষিত : স্মৃতির অতলে থাকা সার্কাস সম্রাজ্ঞী
- Piyali Debnath

- Nov 21, 2024
- 3 min read
Updated: Dec 7, 2024
শহর কলকাতায় শীত একটু একটু করে তার উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। বাঙালির শীতকাল মানেই বোরোলীন-পাটালী-কমলালেবু-পিকনিক-চিড়িয়াখানা আর সার্কাস! সার্কাস বলতেই মনে পড়ে ছিপছিপে বিদেশী তরুনীর দল আর জন্তু-জানোয়ার নিয়ে অদ্ভুত সব খেলা। কিন্তু যদি বলি এমন বাঙালী রমনী বিস্তৃতির অতলে আছেন, যিনি স্বাধীনতারও আগে হয়ে উঠেছিলেন সার্কাসের আইকন- শুনবেন তার গল্প ?

১৯৩০ সালে অবিভক্ত বাংলার কুমিল্লায় ‘অনিমা রক্ষিত’-এর জন্ম। স্কুলে যখন পড়তেন, সেই সময়েই কুমিল্লা থেকে কলকাতায় এসে ওঠে তাঁর পরিবার। খেলাধুলো, শরীরচর্চা, দৌড়, সাঁতার কাটা, গাছে চড়া ইত্যাদি কাজে-কর্মে তাঁর অফুরান উৎসাহ ছিল সেই ছোটোবেলা থেকেই। বাড়ির অমতেই একপ্রকার জেদ ধরে কলকাতায় জাতীয় ‘ক্রীড়া ও শক্তি সংঘ’ নামের একটি যোগচর্চা কেন্দ্রে ভর্তি হন অনিমা। ওই ছোট বয়সেই এই সংঘের কর্ণধার শম্ভু মল্লিকের সঙ্গে নানা জায়গায় ক্যাম্পে উপস্থিত থাকতেন তিনি। এগারো বছর বয়সে পুরোপুরি শরীরচর্চায় মনোনিবেশ করার জন্য শম্ভু মল্লিকের সংঘ থেকে রেবা রক্ষিত চলে আসেন বিষ্টু ঘোষের কুস্তির আখড়ায়। তাঁর কাছে আসন আর যোগাভ্যাসের পাঠ নেন; একই সময়ে বিষ্ণুচরণ ঘোষের কাছে পেশি ও শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণের খেলা শিখে নেন তিনি। সেই সময়েই যোগাভ্যাসের পাশাপাশি প্রাণায়ামের পাঠও রপ্ত করেছিলেন। অনিমার আগ্রহ ও উৎসাহ দেখে বিষ্টু ঘোষ নিজেই এক সার্কাসের মালিকের সঙ্গে কথা বলে শোয়ের বন্দোবস্ত করে দেন। সার্কাসের জগতে এসে অনিমা রক্ষিত হয়ে গেলেন ‘রেবা রক্ষিত’ সেই শুরু হল রেবার পথচলা।
স্বাধীনতার দুই বছর আগে, সার্কাসের একটা ম্যাটিনি শো-তে বুকের উপর দিয়ে মোটর সাইকেল চালিয়ে এক দুঃসাহসিক নজির তৈরি করেছিলেন রেবা রক্ষিত।বুকের উপর মোটরসাইকেল উঠিয়ে দেওয়ার এই মারণ খেলা তাঁকে ক্রমে আরও জনপ্রিয়তা দিলো। শুনলে আশ্চর্য হতে হয়, তাঁর বয়স তখন মাত্র পনেরো-ষোলো বছর। নির্ভীক এই বঙ্গমহিলার কাণ্ড দেখে দর্শকরা ভয়ে চোখ বুজে ফেলতেন সেই সময় আর সেটাই ছিল তাঁর শোয়ের বিশেষত্ব।

এমনই এক সন্ধ্যায় ঘটল দুর্ঘটনা।
দর্শক আসন তখন কানায় কানায় পূর্ণ। রেবা রক্ষিত মঞ্চে টানটান শুয়ে তৈরি। আর তারপরেই বাইকের ভারী সামনের চাকাটা চলে গেল তার উপর দিয়ে রোজকার মতই। কিন্তু রেবা টের পাননি, বিপদ সেদিন তার পিছু নিয়েছিল। পিছনের চাকাটা ওঠার পরেই মুখের কাছে প্রচণ্ড জোরে আঘাত পান রেবা, চোখে মুখে তখন অন্ধকার দেখছেন। গালে বসে গেল টায়ারের কালো দাগ। টানা দু মাস দগদগে ছিল সেই দাগ। সেই দুর্ঘটনায় রেবার প্রাণসংশয় হলেও রেবা ফিরে এলেন। দমে যাওয়ার পাত্রী তিনি নন, তবে মোটর সাইকেলের খেলাকে এবার বিদায় জানানোর পালা।
মোটর সাইকেলের পরে এবার শুরু হল বুকে হাতি তোলার খেলা।
তখন পঞ্চাশের দশক। সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া দেশে তখন সাড়া ফেলেছিল প্রিয়নাথ বসুর গ্রেট বেঙ্গল সার্কাসের দারুণ সব খেলা। শুধু তাই নয়, প্রিয়নাথ বসুর অনুসরণে আরও বেশ কিছু সার্কাসের দল গড়ে উঠলো ভারতে। সমস্ত দেশ জুড়ে তখন এই সার্কাসগুলির মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে নিত্য নতুন খেলা দেখানোর।
ট্রায়াল শো-তে পঞ্চাশ-ষাট মণ ওজনের বাচ্চা হাতি রেবা অনায়াসে বুকে তুলে নিলেন। অবশেষে চূড়ান্ত শো, পূর্ণবয়স্ক একটি হাতি সেদিন অনায়াসে রেবার বুকের উপর দিয়ে হেঁটে চলে যায়, রেবা তখনও অক্ষত এবং প্রাণোচ্ছ্বল। এরপরই নানা সার্কাস থেকে ডাক আসতে থাকলো। রেবা ক্রমান্বয়ে দেখাতে শুরু করলেন তাঁর হাতির খেলা। শো-পিছু উপার্জনও হতে লাগলো ভালোই। সেকালের হিসেবে শনিবার কিংবা রবিবারের প্রতি শো-পিছু ২০০ থেকে ২৫০ টাকা উপার্জন করতেন রেবা। এই খেলাই সমগ্র ভারতে তাঁকে সার্কাসের সম্রাজ্ঞী বানিয়ে তুলেছিল।

গ্রেট বম্বে সার্কাসে টানা আট বছর এই হাতির খেলা দেখিয়েছেন তিনি।
বুকের উপর পেতে রাখা কাঠের তক্তা দিয়ে হাতি হেঁটে চলে যেত। রেবা নির্বিকার শুয়ে থাকতেন, পরে কাঠের তক্তা সরানো হলে উঠে আসতেন হাসিমুখে। ইন্টারন্যাশনাল সার্কাসের হয়ে শেষবারের মতো খেলা দেখিয়েছিলেন এই বাঙালি কন্যা। ১৯৫৫ সালে ‘মিস বেঙ্গল’ হন রেবা, ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত করে। সুদূর আমেরিকার Ida Jo Pajunen সম্প্রতি রেবা’কে নিয়ে লিখেছেন Strong Woman Reba Rakshit: The Life and Adventures of a Stuntmaster. তবে বাঙালির স্মৃতির পাতায় ‘রেবা রক্ষিত’ অনুজ্জ্বল এক ক্ষীণ জ্যোতিষ্কের মতোই অনালোচিত থেকে গিয়েছেন আজও।

রেবা রক্ষিত কেন বিশেষ:
হাতির মতো ভারী প্রাণীকে বুকে তুলে ধরে রাখার জন্য অসাধারণ শারীরিক শক্তির প্রয়োজন। রেবা অবশ্যই সেই শক্তির অধিকারী ছিলেন। তবে শুধু শক্তি বা শারীরিক ক্ষমতা নয়, রেবা রক্ষিত হওয়ার জন্য এই 2024-এও প্রচুর সাহসের প্রয়োজন। আজকের দিনে যখন আমরা নারীশক্তির কথা বলি, তখন রেবা রক্ষিতের মতো মেয়েদের মনে রাখা জরুরি। রেবা সেই কবে দেখিয়ে গিয়েছেন - একজন নারী যদি চায়, তাহলে সে সব কিছু করতে পারে।

আজ এই লেখা পড়ে সুকুমার রায়ের লেখা ‘পালোয়ান’ নামের ছড়ার সেই বিখ্যাত পঙ্ক্তি - ‘খেলার ছলে ষষ্ঠীচরণ, হাতি লোফেন যখন তখন / দেহের ওজন উনিশটি মণ, শক্ত যেন লোহার গঠন’ শুনে বা পড়ে আপনার মনে যদি গোফওয়ালা কোনও পালোয়ান পুরুষ এর পাশাপাশি পঞ্চাশের দশকের কোনও বাঙালি রমনীর অবয়ব মনে পড়ে তাহলেই এই লেখা সার্থক।




_edited.jpg)



কত কী জানতে পারছি। কেয়াবাৎ কেয়াবাৎ কেয়াবাৎ কেয়াবাৎ