top of page

জর্জ ম্যালরি এবং অরভিন: এভারেস্টের অজানা ইতিহাস

এভারেস্টকে বলা হয় পৃথিবীর তৃতীয় মেরু। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকেই পৃথিবীর দুই মেরুতে মানুষ তার পায়ের ছাপ ফেলেছিল; বাকি ছিল শুধু এভারেস্ট। এই এভারেস্টের চূড়ায় নিজেদের সাফল্যের চিহ্ন এঁকে দেওয়ার জন্য সবার আগে আগ্রহী হয়ে উঠেছিল ব্রিটিশ পর্বতারোহীরা। 

 

সাল ১৯২১ 


বলাই বাহুল্য বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ১৯২১ সালে এভারেস্টের চূড়া জয়ের প্রথম পরীক্ষামূলক চেষ্টাটি করেছিলেন ব্রিটিশ পর্বাতোরহী-রা। এই পরীক্ষামূলক অভিযানের একজন সদস্য ছিলেন ইংল্যান্ডের মবেরিতে ১৮৮৬ সালে জন্ম নেওয়া জর্জ ম্যালরি। এই অভিযানে তিব্বতের দিক দিয়ে এভারেস্টের চূড়ায় ওঠার রাস্তা আবিষ্কার করেছিলেন জর্জ ম্যালরি এবং গাই বুলক। যেহেতু এভারেস্ট জয় করতেই হবে এমন কোনো পরিকল্পনা সেবার ছিল না, বরং পরীক্ষামূলক অভিযান ছিল, তাই সেইবারে তারা নর্থ কোল এর বেশি উপরে উঠতে পারেন নি। 


Mallory
George Mallory during the British Everest expedition in 1921

সাল ১৯২২


রাস্তা আবিষ্কার হওয়ায়, এবার চূড়ায় ওঠার নেশাও আগের চাইতে বেড়ে গেল। ফলে এর পরের বছর ১৯২২ সালেই আরেকটি অভিযান চালানো হয়েছিল, যা ছিল এভারেস্ট জয়ের সর্বপ্রথম

পরিকল্পিত অভিযান।এই অভিযানের সাথেও যুক্ত ছিলেন ব্রিটিশ পর্বতারোহী ম্যালরি। দুর্ভাগ্যবশত এই অভিযানে ৭ জন শেরপা তুষার ঝড়ের কবলে পড়ে মারা যান। ব্যর্থ মন নিয়ে এভারেস্টের চূড়ার অনেকটা কাছ থেকে ফিরে আসেন ম্যালরি সহ বাকি দল। ম্যালরি ধরেও নিয়েছিলেন তাঁর হয়তো আর এভারেস্টের চূড়ায় ওঠা হবে না।  

ইতোমধ্যে বয়স এসে ঠেকেছে ৩৫-এ এবং ৩ সন্তানের জনক হয়েছেন তিনি। কিন্তু এভারেস্টের নেশা তাঁকে আর ছাড়ে না। যে করেই হোক এভারেস্ট জয় করতেই হবে- এই ছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান।  


সাল ১৯২৪ 


এভারেস্ট জয়ের অদম্য ইচ্ছা নিয়ে আবারো অভিযানের পরিকল্পনা করলেন জর্জ ম্যালরি। তাকে এই অভিযানের পরিকল্পনা করতে দেখে বেশ মুষড়ে পড়লেন ম্যালরির স্ত্রী রুথ। সন্তান এবং পরিবারের কথা বলে স্ত্রী তাঁকে বোঝাতে চাইলেন যে পরিবারের পাশে, সন্তানদের পাশে তাঁকে খুব প্রয়োজন। কিন্তু ম্যালরি যে সেই কবে থেকেই এভারেস্টকে মন দিয়েছেন; তাই তাঁকে আটকানো গেল না। স্ত্রীকে কথা দিলেন,‘ যদি এভারেস্ট জয় করতে পারি তাহলে পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়ায় তোমার একটা ছবি রেখে আসব’। স্ত্রীকে দেওয়া এই প্রতিশ্রুতিই পরবর্তীতে গোটা পৃথিবীর মানুষকে নিয়ে গেছে এক গভীর রহস্যের অন্তরালে। 


Couple
George & With His Wife

সেবার এভারেস্ট অভিযানের যাওয়ার আগে থেকেই নিউ ইয়র্কে ম্যালরিকে নিয়ে সংবাদ সম্মেলন হয়। এই সংবাদ সম্মেলনে ম্যালরিকে একটি প্রশ্ন করা হয়েছিল, এবং এর উত্তরে তিনি যা বলেছিলেন, তা মানব ইতিহাসের অন্যতম আলোচিত একটি উক্তি। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আপনি কেন মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় উঠতে চান? এর উত্তরে তিনি বলেছিলেন, - ‘বিকজ ইটস দেয়ার!’


Last seen
Mallory & Irvin at the base camp of The Everest (the last picture of the duo)

সাল - ১৯২৪

স্থান- এভারেস্ট বেস ক্যাম্প। 


অবশেষে ৩৭ বছর বয়সী জর্জ ম্যালরি যাত্রা শুরু করলেন এভারেস্টের দিকে। এবার সঙ্গী, ২২ বছর বয়সী অরভিন। ১৯২৪ সালের এই অভিযানের প্রথম দুটি প্রচেষ্টা সম্পূর্ণ করতে পারেননি তারা। এদিকে জুন মাস, আসছে মৌসুমি আবহাওয়া। এখানে দেরি করা সম্ভব নয়। সম্ভবত এখান থেকেই স্ত্রীকে শেষবারের মতো চিঠি পাঠিয়েছিলেন জর্জ। লিখেছিলেন, “বর্ষাকাল এগিয়ে আসছে। এর পর আর ওঠার সুযোগ পাবো কি না জানি না। আমি এখানে পড়ে থাকতে চাই না। পরশুদিন আমরা যাত্রা শুরু করতে চাই।”

এরপর এই দুজন এভারেস্ট জয়ের পণ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো অভিযান শুরু করেন। ৪ জুন তারা দুজন অ্যাডভান্স বেসক্যাম্প থেকে রওনা করে পরের তিন দিনে ৬ নাম্বার বেস ক্যাম্পে পৌঁছ্লেন। এর পরদিন ৮-ই জুন দুজন ৬ নং বেসক্যাম্প থেকে রওনা করে সেদিন দুপুরের মধ্যে চূড়ার খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন। সেই শেষবারের মতো তাদের দেখা গিয়েছিল ৮,৬০০ মিটার উচ্চতায়। এখান থেকে বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশ্রেনীর চূড়া আর মাত্র আড়াইশো মিটার। 

এই পর্যন্ত পড়ে আপনার মনেও আমার মত প্রশ্ন জাগতে পারে, তারা কি পেরেছিলেন শেষ পর্যন্ত? তাদের এই অন্তর্ধান পর্বতারোহণের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় রহস্যের জন্ম দিয়েছে, যার উত্তর আজও অজানা। 

Irvin
Andrew Irvin


সাল ১৯৫৩


এর ২৯ বছর পর ১৯৫৩ সালের ২৯ শে মে নিউজিল্যান্ডের এডমন্ড হিলারির সাথে, নেপালের শেরপা তেনজিং নোরগে এভারেস্টের চূড়ায় পা রাখেন।


সাল ১৯৯৯

 

১৯৭৫ সালের এক এভারেস্ট অভিযানে একজন চীনা পর্বতারোহী একজন ইংরেজের মৃতদেহ দেখতে পেয়েছেন বলে জানান। এর আগে ১৯৩০ সালের এক অভিযানে অরভিনের আইস এক্স খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল ৮,৪৪০ ফুট উচ্চতায়। এরপর ১৯৯১ সালের এক অভিযানে ১৯২০ সালের অভিযানে ব্যবহৃত অক্সিজেন ক্যানিস্টারও খুঁজে পেয়েছিল একটি অভিযাত্রী দল। এভাবেই ছোট ছোট কিছু নমুনা পাওয়া যাওয়াতে ১৯৯৯ সালে শুধুমাত্র এই দুজনকে খুঁজতে একটি আলাদা অভিযান পরিচালনা করা হয়েছিল। এই অভিযানের মূল উদ্দেশ্য ছিল ম্যালোরি এবং অরভিনের মৃতদেহ এবং তাদের ক্যামেরা খুঁজে বের করা। কারণ, যদি ক্যামেরাটি খুঁজে পাওয়া যায়, তাহলে হয়তো সেখান থেকে জানা যেতে পারে তারা আসলে সর্বপ্রথম এভারেস্টের চূড়ায় পা রাখতে পেরেছিলেন কি না। ১৯৯৯ সালের এই অভিযানে অরভিনের মৃতদেহ বা তাঁর কোডাক ক্যামেরার কোনোটিই খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল জর্জ ম্যালরির মৃতদেহ। বেসক্যাম্প থেকে সাথে নিয়ে যাওয়া সবকিছু ম্যালরির পোষাকের মধ্যেই পাওয়া গিয়েছিল। শুধু ছিল না তাঁর স্ত্রীর ছবি, যে ছবিটি তিনি এভারেস্টের চূড়ায় রেখে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী-কে। এরপর রহস্য আরও ঘনীভুত হয়। প্রশ্ন ওঠে তাহলে কি তিনি সেই ছবি এভারেস্টের চূড়ায় রেখে এসেছিলেন আর নেমে আসার সময় তুষার ঝড়ে তাদের মৃত্যু হয়েছিল? এই অভিযানে ম্যালরির স্নো গগলসটিও পাওয়া গিয়েছিল তার জামার পকেটে। চোখের স্নো গগলস পকেটে থাকার কারণে তাদের এভারেস্টের চূড়ায় ওঠার সম্ভাবনাও আর দৃঢ় হয়ে উঠে। ধারণা করা হয়, শেষবার তাদেরকে যেখানে দেখা গিয়েছিল সেখান থেকে চূড়ায় উঠতে গেলে সন্ধ্যার আগেই উঠে যাওয়া সম্ভব ছিল। অর্থাৎ তারা চূড়ায় উঠেই স্নো গগলস খুলে পকেটে রেখেছিলেন এবং এভারেস্টের শিখর থেকে সন্ধ্যায় নামার সময়ই দুর্ঘটনার কবলে পড়েন। 

Finding
One of George Mallory’s boots and a few personal effects were found beside his remains on Everest in 1999

সাল ২০২৪


আজ থেকে ঠিক দুই মাস আগে অর্থাৎ সেপ্টেম্বর মাসে মাউন্ট এভারেস্টের উত্তর মুখের নীচে, সেন্ট্রাল রংবুক গ্লেসিয়ারের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে, পরিচালক জিমি চিন- এর নেতৃত্বে National Geographic চ্যানেলের চলচ্চিত্র দল শ্যুট করতে গিয়ে বরফের নিচে একটা অদ্ভুদ দর্শন জিনিস দেখতে পায়। কাছে যেতেই তারা বুঝতে পারে, জিনিসটা আসলে একটি জুতো-মোজা পরা পা! জুতোটি্র চামড়া ঘষা, এবং মোজাটিতে একটি লাল লেবেল লাগানো, যার উপর সেলাই করা একটি নাম - A.C. IRVINE !


Jimmy Chin
Filmmaker and mountain climber Jimmy Chin With the latest found body Part of Irvin (Photo Courtesy : National Geography)

১০০ বছর ! 

জর্জ ম্যালোরির সাথে অদৃশ্য হওয়ার পর তন্ন তন্ন করে খোঁজা হলেও সেই দুর্ঘটনার ১০০ বছর পর এই প্রথম অ্যান্ড্রু কমিন আরভিনের দেহের কোনও অংশ পাওয়া গেল হিমালয়ের বুকে। 

আরভিন এবং ম্যালোরিকে শেষবার দেখা গিয়েছিল ৮ জুন, ১৯২৪-এ, এভারেস্টের চুড়ার খুব কাছাকাছি।  তারা শিখরে পৌঁছতে পেরেছিলেন কিনা এই প্রশ্নের উত্তর আজও রহস্যে মোড়া। ম্যালোরিরা যদি সফল হতেন, তবে তাদের কীর্তি তেনজিং নোরগে এবং এডমন্ড হিলারির এভারেস্টের শীর্ষে পৌঁছানোর ২৯ বছর আগে হত। 

ম্যালোরির খুঁজে পাওয়া দেহ তাদের দুইজনের শেষ পরিনতি সম্পর্কে বেশ কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে, কিন্তু দুটি গুরুত্বপুর্ণ প্রশ্নের উত্তর এতদিন পাওয়া যায়নি - 


 ১। আরভিন শেষ সময়ে কোথায় ছিলেন? 

২। তাদের জুটি কি শেষ পর্যন্ত শিখরে পৌছেছিল? 


পর্বতারোহী এবং ইতিহাসবিদরা দীর্ঘদিন ধরে ভেবেছিলেন যে প্রথম প্রশ্নের উত্তর দ্বিতীয়টি সম্পর্কে ইঙ্গিত দিতে পারবে। 

এখন হিমালয়ের বুকে দীর্ঘকাল নিভৃত শয়ানে থাকা এই ‘জুতো-মোজা পরা পা’ আশা জাগাচ্ছে যে ১৯২৪ সালে এভারেস্টের বুকে ঠিক কী ঘটেছিল এবার হয়ত তার সঠিক ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে ।

আমরা যারা রোজ হেরে যেতে যেতে ক্লান্ত, তাদের জন্য রহস্যময় পর্বতশ্রেনীর বুকে এই নতুন আবিস্কার যেন টাটকা ফুলের সুবাস। এই আবিস্কার আমাদের কাছে হার না মানার এক আবেদন পত্র।



1 Comment

Rated 0 out of 5 stars.
No ratings yet

Add a rating
Ajitesh Nag
Nov 11, 2024
Rated 5 out of 5 stars.

Excellent

Like
bottom of page