
ভুতুড়ে ভানগড়।
- Piyali Debnath

- Oct 2, 2024
- 5 min read
রাজকুমারী রত্নাবতী ছিলেন সুন্দরী আর বুদ্ধিমতী। সিন্ধিয়া নামের কালোজাদুতে সিদ্ধহস্ত এক তান্ত্রিক রাজকুমারীর সেই রূপে পাগল হয়ে তাকে নিজের করে পেতে চায়। কিন্তু তার পক্ষে তো সুন্দরী রাজকুমারীকে সোজাপথে পাওয়া সম্ভব নয়! অসম্ভবকে সম্ভব করতে তাই সেই তান্ত্রিক ফন্দি আঁটতে থাকে। একদিন রাজকুমারী রত্নাবতী যখন সখীদের সঙ্গে নিয়ে বিশেষ ধরনের সুগন্ধি তেল আনতে যাচ্ছিলেন তখন সিন্ধিয়া কায়দা করে রাজকুমারীকে মন্ত্রপড়া তেল দিয়ে দেয়। ওই তেলের প্রভাবে সম্মোহিত হয়ে রাজকুমারী তার কাছে চলে আসবে- কুটিল জাদুকর এমনটাই ফাঁদ পেতেছিল। কিন্তু তেল নিয়ে যাদুকরের কারসাজি রাজকুমারী বুঝে ফেলে ওই যাদু তেলের শিশি একটা বড়সর পাথরে আছার দিয়ে ভেঙে ফেলেন। এরপর যাদু তেলের প্রভাবে ওই পাথরটি তান্ত্রিকের দিকে চলতে শুরু করে ও একসময়ে তান্ত্রিকের ওপর চেপে বসে এবং নির্মমভাবে সেই তান্ত্রিকের মৃত্যু হয়। নির্মম সেই মৃত্যুর মুহূর্তেই প্রতিশোধ নিতে মরিয়া তান্ত্রিক ভানগড় নগরকে বিনাশ করার প্রতিজ্ঞা করে। কথিত আছে, তান্ত্রিকের মৃত্যুর পরের দিনের সূর্য ওই নগরের কেউ আর দেখেনি- রাজকুমারী রত্নাবতীসহ নগরের সবাই এক রাতেই শেষ হয়ে যায়। ঘটনাটি কীভাবে ঘটেছিল- তা নিয়ে যদিও নানা লোককথা রয়েছে। অনেকে বলে, ভানগড় একরাতে শেষ হয়নি। মৃত্যুর আগে সিন্ধিয়া রাজকুমারীকে বলে যায়,রাজপরিবারের কাউকে সে বাঁচতে দেবে না। আর খোদ রত্নাবতীকে সে মরার পরেও ছাড়বে না। এর কিছুদিন পর প্রতিবেশী রাজ্যের সঙ্গে ভানগড়ের ভীষণ যুদ্ধ বাঁধে। যুদ্ধে রাজপরিবারসহ গোটা ভানগর ধ্বংস হয়ে যায়। স্থানীয়দের বিশ্বাস ওই কেল্লায় নাকি তান্ত্রিক ও রত্নাবলীর অতৃপ্ত আত্মা এখনও ঘুরে বেড়ায়।
গুগলে এতক্ষণ যেটা পড়তে মগ্ন ছিলাম সেটার বাংলা করলে মোটামুটি এরকমই দাঁড়ায়। ফোনের স্ক্রিন থেকে চোখ সরাতে বাধ্য হলাম কারন গাড়ির চালক একটা পেল্লায় সাইজের গেটের অদূরে দাড় করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘অন্ধেরা হোনেসে প্যাহেলে ইধারসে হামকো চলনা হ্যায় লেকিন।‘ ঘড়ি বলছে, এখন সময় দুপুর একটা বেজে আট ; চোখ বলছে, ভাঙা রাজপ্রাসাদও এতো সুন্দর হতে পারে! মন বলছে, কিছু তো এখানে নিশ্চয়ই আছে! আমি এইমুহুর্তে দাঁড়িয়ে আছি রাজস্থানের আলবড় জেলায় অবস্থিত ‘The most haunted place in Asia, ভানগড় ফোর্টের সামনে যেখানে সূর্যাস্তের পর আর সূর্যোদয়ের আগে প্রবেশ একেবারেই নিষেধ করে দিয়েছে ‘আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া’ কর্তৃপক্ষ।
আজ আকাশ অংশত মেঘলা এবং কোনও অজানা কারণে এখানে টুরিস্টের সংখ্যা বেশ কম। খুব কাছে কোথাও একটা ময়ূর কর্কশ গলায় বেশ অনেক্ষন ধরে কাকে যেন ডেকে চলেছে, চারপাশে ঘন সবুজের সমারোহে যাকে আমার চোখ এবং রোদ চশমা কেউই খুঁজে পেল না।মূল গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে সেই সবুজ পেরিয়ে চারপাশে হিন্দী ও ইংরাজিতে লেখা বিভিন্ন সাবধানবাণী পড়তে পড়তে কখন যে মূল দূর্গের সামনে এসে দাড়িয়েছি তা নিজেও বলতে পারব না। এইফাঁকে বলে রাখি ভানগড় নগরে আপনি প্রবেশ করতে গেলে প্রথমেই চোখে পড়বে নগরের একসময়কার জমজমাট বাজারটির ভগ্নস্তুপ। রাস্তার পাশের দোকানগুলোর দেওয়াল এখনও দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু তাদের ছাদগুলো নেই। নেই মানে, দেখে মনেই হয় না কখনো সেখানে ছাদ জাতীয় কিছু ছিল বা মনে হবে কেউ ধারালো তলোয়ার দিয়ে ওইসব ঘরের ছাদগুলো কেটে ফেলে দিয়েছে । মুল গেটের বায়রে নগরের আশেপাশের বাড়িগুলোও তথৈবচ।
প্রায় ত্রিশ ফুট উচু পাথরের ফটক পেরিয়ে মুল প্রাসাদের ভেতরে ঢুকেই প্রথমে নাকে এলো বোটকা একটা গন্ধ যার বর্ণনা ছোটথেকে প্রচুর ভুতের গল্পে পড়েছি। গা ছমছমে আলো আধারিতে চোখ সয়ে এলে সবার প্রথমে চোখ গেলো দেওয়ালের ‘সোনু লাভস সুইটি’তে, আর তার ঠিক পাশ দিয়েই ওপরে ওঠার সিড়ি। ওপরে উঠে একটা খোলা ব্যালকনির মত জায়গায় এসে দাঁড়ালাম। সামনে যতদুর চোখ যায়, ততদুর বিভিন্ন ধরনের চোখজুড়ানো সবুজ, ইতিউতি পুরোনো কয়েকটা মন্দির, একজোড়া আত্মমগ্ন ময়ূর, একটা নাম না জানা উজ্জ্বল রঙের পাখি দেখে আমার ভুত-ভবিষ্যত সব হিসেব তখন গুলিয়েছে। সেই সুবিশাল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের সামনে দাঁড়িয়ে আমি রত্নাবতীর কথা প্রায় ভুলতে বসেছি এমন সময়ে কানে এলো, ‘ইয়ে গুফা মে জরুর তিন চার ভুত র্যাহতা হ্যায়!’ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম, এক বাবা তার হাত ধরে থাকা ছেলের বেশ ভয় পাওয়া মাকে কথাগুলো বলতে বলতে আরেকটা সিড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেল। আমিও ভয়ের গন্ধ পেয়ে ভুতওয়ালা ‘গুফা’ দেখার জন্য তাদের পিছু নিলাম। সত্যি বলতে সিড়ি দিয়ে যথেষ্ট পা চালিয়ে নেমেও ওই তিনজনের দেখা পেলাম না, কিন্তু যা পেলাম তা আমার তিনদিন একা রাজস্থান ভ্রমনের একটা গোটা বেলা এখানে ইনভেস্ট করা সার্থক করল।
মোবাইলের টর্চের আলো জ্বালিয়েও ভেতরের বিশেষ কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না, এমন একটা ছোট দরজা দিয়ে সাবধানে ঢুকলাম। ঢুকে দেখি ঘরের ভেতর আরেকটা খুপরি ঘর আর সেই ঘরের কোণা দিয়ে একজন মানুষ গলে যাওয়ার মতো একটা সুড়ঙ্গ নেমে গেছে। সেই ঘরে আমি তখন একা আর আমার আশপাশ এত নিস্তব্ধ যে নিজের হৃদপিন্ডের ওঠাপড়া নিজে শুনতে পাচ্ছি। সুড়ঙ্গের মুখের দিকে যতো এগোচ্ছি ততো নাকে সেই ভুতের গল্পে পড়া বোটকা গন্ধের তীব্রতা বাড়ছে। কাছে কোথাও কর্কশ কন্ঠে একটা ময়ূর ডেকে উঠল। আমি একবার যেন কেঁপে উঠলাম। এক ঝলক মনে হলো, মা সাথে থাকলে কি এই সুড়ঙ্গের ভেতরে আমাকে একা নামতে দিত? নাকের নিচে জমতে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম হাতের তালুর উল্টোপিঠ দিয়ে মুছে নিলাম, মনে মনে দুবার সেই অমোঘ মন্ত্র,’ভুত আমার পুত, পেত্নি আমার ঝি…’ঝালিয়ে নিয়ে অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে পাথরের গর্ত দিয়ে নীচে নেমে যা দেখলাম তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। একটা মাঝারী সাইজের ঘর যার পলেস্তারা খসা দেওয়ালে এবং ছাদে একটা টিকটিকি ধারনের জায়গা নেই। আকারে ছোট হলেও বুঝতে ভুল হলোনা যে পা ওপরে আর মাথা নীচে দিয়ে ঝুলে থাকা সংখ্যায় কয়ের হাজার ঘন ছাই রঙের বাদুড়ে ভর্তি সেই ঘর! সেখান থেকে বেরোবার রাস্তা খুঁজতে গিয়ে আরও কয়েকটা কানে কানে অতীতের গল্প বলতে চাওয়া অন্ধকার ঘর, শুধু ঘুলঘুলি দিয়ে আসা আলোকে সম্বল করে কয়েকশো বছর ধরে দুর্গ পাহারা দেওয়া সুড়ঙ্গ, এতো প্রতিঘাতেও সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পাথরের সিঁড়ি পার করে যখন দুর্গের বায়রের ঘাসজমিতে এসে দাঁড়ালাম তখন সূর্য্যদেবতা ঘুমনোর তোড়জোড় করছেন এবং আমার একটু শীতশীত করছে। জানি এখনও অনেকটা রাস্তা হেটে আমায় মুল গেটের বায়রে যেতে হবে এবং গত কুড়ি-পঁচিশ মিনিটে এ জন্মের মতো আমার ভুতের ভয় পেতে চাওয়ার সাধ ঘুচেছে। কিন্তু তাও আরেকবার পেছন ফিরে দুর্গটাকে দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। আর পেছন ফিরে এই প্রথম আমার সারা গায়ে কদম ফুটল! না, ভুতের ভয়ে নয়। জীবনে প্রথমবার ইতিহাসের প্রতি এক অমোঘ আকর্ষণে, অতীতের প্রতি অপারগতায়। গুগল খুললে এশিয়ার সেরা ভৌতিক স্থান হিসেবে আখ্যা পাওয়া এই ফোর্ট নিয়ে কত গল্প, কিন্তু আসল সত্যিটা প্রতিটা ইট-পাথরে জারণ করে কয়েকশো বছর ধরে আবিচল ভাবে দাঁড়িয়ে যেন ভানগড়ের না-বলা ইতিহাস গোপনে বহন করে চলেছে এই দূর্গ। পড়ন্ত আলোয় সেই মুহুর্তে আমার মনে হল, এখন রাজকুমারী রত্নাবতী হয়তো সখীদের সাথে দূর্গের কোনও কোনায় প্রসাধনে ব্যাস্ত, হয়তো এখনই নাচমহলে জ্বলে উঠবে আলো-বেজে উঠবে নুপুর, এখনই হয়তো কোথাও থেকে ভেসে আসবে সন্ধ্যা আরতির মন্ত্রোচ্চারণ অথবা তলোয়ারের ঝনঝনানি; আর সেই অনস্বীকার্য অতীতকে আমরা ব্যাখ্যা করবো ভৌতিক বলে।
‘আপ আভিতক গ্যায়ে নেহি? ইতনা দের ইয়াহা রুকনা মানা হ্যায়। যাইয়ে যাইয়ে…‘ ইতিহাসে পাতা থেকে সটান আছাড় খেলাম এইমাত্র বাইকে করে আসা পাগড়ি পড়া দুজন রাগী দেখতে মধ্যবয়স্কের কাছে। জানতে পারলাম এনাদের দায়িত্ব সন্ধ্যা ছটা’র আগে সবাইকে দূর্গ থেকে বের করে দেওয়া এবং ‘উনকে লিয়ে’ ধুপুকাঠি জ্বালিয়ে কয়েরটা কুচো ফুল রেখে চলে যাওয়া। এই ‘উনকে লিয়ে’র ব্যাখ্যা যদিও ওনারা আমাকে দেননি।
মূল গেট দিয়ে বেরিয়ে যখন গাড়ির দিকে যাচ্ছি, তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে, অনেক অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা মাঠ ও ছাদহীন পরিত্যক্ত বাড়িগুলো চুইয়ে অন্ধকার নামছে। আমার সারথীকে দেখে মনে হল আমি যেন স্কুলে সবকটা অঙ্ক ভুল করে বাড়ি ফেরা ক্লাস ওয়ানের বাচ্চা। সে যত ফেরার তোড়জোড় করছে আমি ততই আরেকবার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখানে ফিরে আসার ইচ্ছেদেরকে প্রশ্রয় দিচ্ছি।
নিন্দুকেরা বলবে ভাঙ্গাচোরা আগোছালো ভুতুড়ে জায়গা নিয়ে এতো আদিখ্যেতার কি আছে ? জ্ঞানীরা বলবেন, রাজস্থান ঘোরার itinerary তে এই জায়গার নাম নেই পর্যন্ত…আমি বলব, আমাদের রোজকার জীবনের বাঁধা বিঘ্ন আলস্য বিলাসিতা পেরিয়ে একটা ফাঁকা মাঠ আছে। আমাদের ওঠাপড়ার বিভিন্ন ঘটনা, কাছের মানুষের ছেড়ে যাওয়ার দুঃখ, হঠাত পাওয়ার অপ্রত্যাশিত আনন্দেরা সেখানে শান্ত নয়ণে ধ্যানে মগ্ন। সেই মাঠ পেরিয়ে, এই ইট-কাঠ-পাথরের কাছে এসে পা ঝুলিয়ে বসে ইতিহাসের গায়ে কান পাতার লোভ সামলানো দায়! কারণ রহস্যে মোড়া ইতিহাসের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে অন্যভাবে আবিস্কারের ইচ্ছেটুকুই তো জীবন !
বিঃদ্রঃ ঘুরে বেড়ান, ভাল থাকুন ভালো রাখুন। যেটুকু দরকার সেটুকুই হেঁহেঁ করুন। যারা সঙ্গে থাকার, ঠিক থেকে যাবে।





_edited.jpg)



Comments