top of page

এক জাহাজ সফর, যা বদলে দিয়েছিল ভারতবর্ষের ভবিষ্যতের রূপরেখা।

Updated: Nov 3, 2024

সাল ১৮৯৩, সেপ্টেম্বর মাস, আকাশে চকচকে সোনা রঙের রোদ। সকাল সকাল জাপানের যোকোহামা থেকে ভ্যাংকুভারের উদ্দেশ্যে রওনা হল এক বিশাল বাষ্পীয় জাহাজ, 'এম্প্রেস অফ ইন্ডিয়া'! উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের জল ঘন নীল এবং শান্ত। গন্তব্যে পৌঁছাতে সময় লাগবে আনুমানিক আট থেকে দশ দিন। এই সকালেই সেই  জাহাজের ডেকে দেখা হল দুই ভারতীয় দিকপালের। এই অকস্মাৎ নিছক সাক্ষাৎ ভারতের  ইতিহাসে যে এমন সুগভীর ছাপ ফেলবে তা সেদিন তারা কেউই জানতেন না।


Ship
Empress Of India Ship (Image source: Wikimedia)

ভারতের শিল্প ও ব্যাবসার জগতের অন্যতম দিকপাল জামসেদজি টাটা তখন শিকাাগোর একটি শিল্প প্রদর্শনীতে যাওয়ার পথে জাপানে ছিলেন কিছুদিন, উদ্দেশ্য সেই দেশ থেকে দেশলাই কাঠি আমদানি করা। ঘটনাচক্রে এই  সময়ই  বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তিত্ব স্বামী বিবেকানন্দ-ও জাপানে একই হোটেলে থাকছিলেন শিকাগো যাওয়ার পথে। কিন্তু জাপানে থাকাকালীন আলাপ-আলোচনার সুযোগ না হলেও ‘এম্প্রেস অফ ইন্ডিয়া’র ডেক ও একটি রৌদ্রজ্জ্বল দিন সেই সুযোগ করে দিল।

জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে, দুই মহাপুরুষের মধ্যে শুরু হল গভীর আলোচনা। বিবেকানন্দ তাঁর আধ্যাত্মিক যাত্রার অভিজ্ঞতা ভাগ করলেন, জানালেন সেখানে তিনি দেখেছেন কিভাবে উপনিবেশিক শাসক তার fellow ভারতীয়দের উপর নির্যাতন চালাচ্ছে। আরও জানালেন, চীনে থাকাকালীন, ক্যান্টনের (গুয়াংজু) বৌদ্ধ মঠে তিনি অনেক সংস্কৃত ও বাংলায় লেখা পান্ডুলিপি দেখেছিলেন। সেই সাক্ষাতে তাঁরা জাপানের প্রযুক্তির অসাধারণ উন্নতি নিয়েও দীর্ঘ আলোচনা করেন।   

Swami Vivekananda & Jamsetji Tata
Swami Vivekananda & Jamsetji Tata (Image source : Google)

এদিকে, জামসেদজিও তাঁর উদ্যোগের কথা জানালেন। স্বামিজীকে বললেন তাঁর ভারতে ইস্পাত শিল্পের ভিত্তি স্থাপনের পরিকল্পনার কথা। ভারতের বৃহত্তম ব্যবসায়িক গোষ্ঠীগুলোর একজন প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে, জামসেদজি এও বলেন যে  তিনি এমন সরঞ্জাম ও প্রযুক্তির সন্ধান করছেন যা ভারতকে একটি শক্তিশালী  ব্যাবসায়ী দেশ হতে সাহায্য করবে। স্বামিজী তাঁর পরিকল্পনাকে উদবুদ্ধ করলেন এবং জানালেন পশ্চিমের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সঙ্গে ভারতের আধ্যাত্মিকতা এবং মানবিকতাকে একত্রিত করতে পারলে চমৎকার একটি ব্যাপার হবে! তিনি আরও বললেন, জাপান থেকে দেশলাই কাঠি আমদানির বদলে জামসেদজি ভারতেই তা উৎপাদন করা উচিত,যাতে গ্রামীণ দরিদ্রদের জন্য জীবিকা অর্জনের সুযোগ তৈরি হয়। শিকাগোতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনে তিনি কীভাবে  ভারতের  আধ্যাত্মিক দর্শনের কথা জগৎকে জানাতে এসেছেন, সে  কথাও জানালেন বিবেকানন্দ। 

(প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি সম্মেলনটি আন্তঃধর্মীয়  আলোচনার ক্ষেত্রে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল, যেখানে বিশ্বের  বিভিন্ন ধর্মের প্রায় ৫০০০ জন প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেছিলেন।)


Swami Viekananda
বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনে স্বামিজী (ছবিঋণ : উইকিমিডিয়া)

সময়ের নিয়মে সেই দীর্ঘ আলোচনাও একসময়ে শেষ হল, কিন্তু সেই সাক্ষাৎ জামসেদজি’র হৃদয়ে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। এরপর তাঁদের আর কখনও দেখা হয়নি । কিন্তু এর পাঁচ বছর পরে অর্থাৎ ১৮৯৮ সালের নভেম্বর মাসে তিনি স্বামী বিবেকানন্দকে একটি চিঠি লিখেছিলেন, যেখানে তিনি একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন।


Letter
The Letter Written By Jamsetji Tata ( Image source: TATA Steel )

যদিও স্বামী বিবেকানন্দ তখন রামকৃষ্ণ মিশনের কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, কিন্তু তিনি তাঁর শিষ্যা সিস্টার নিবেদিতাকে জামসেদজির সঙ্গে আলোচনার জন্য পাঠালেন। দুর্ভাগ্যবশত, তাঁদের সেইসময়ের পরিকল্পনা তখনকার ভাইসরয় লর্ড কার্জনের জন্য ফলপ্রসূ হয়নি। কিন্তু জামসেদজি তাঁর উদ্দেশ্যে অবিচল রইলেন। ১৮৯৮ সালে, তিনি মাইশোরের দেওয়ান শেষাদ্রি আইয়ার-এর সঙ্গে  আলোচনা করে মাইশোরের রাজাকে বোঝাতে সক্ষম হন, এবং রাজা জামশেদজীর গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জন্য জমি দিতে রাজি হন।


এভাবেই জামসেদজির স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি স্থাপন হয়। ১৯০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত 'টাটা ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স' পরে ভারতীয় বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানে (আই আই এস সি) রূপান্তরিত হয়।

স্বামীজি ১৯০২ সালে মৃত্যুবরণ করেন এবং জামসেদজি তার ঠিক দুই  বছর পরে। তাঁদের সেই স্বপ্ন, যা তাঁরা একসাথে দেখেছিলেন, তা ১৯১১ সালে বাস্তবে রূপায়িত হয়। আজকের দিনে, ISSC  ভারতবর্ষের গর্ব এবং বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান গুলোর মধ্যে একটি। টাটা গ্রুপের পরবর্তী উদ্যোগগুলির মধ্যে 'টাটা ইনস্টিটিউট অফ সোশ্যাল সায়েন্সেস' এবং 'টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ'ও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।


টাটাগ্রুপ-এর সুনাম ও কর্মকান্ডের সৌরভ আজ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে, কিন্তু ভাবতেও অবাক লাগে এই সবের শুরু ১৩১ বছর আগের সেদিনের সেই জাহাজ সফরে, যা  আমাদের  ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে জ্বলজ্বল করছে।


Comments

Rated 0 out of 5 stars.
No ratings yet

Add a rating
bottom of page