top of page

বুড়ীমার চকোলেট বোমা : এক জীবনযুদ্ধ জয়ের আশ্চর্য রূপকথা ।

Updated: Oct 29, 2024

কালীপুজা এলে আপামর বাঙালী দুই মা-কে স্মরণ করে। এক হলেন মা কালী স্বয়ং আর আরেকজন ‘বুড়ীমা’। কালীপুজোয় বুড়ীমার চকলেট বোম ফাটায়নি বা দেখেনি এমন বাঙালী খুঁজে পাওয়া মুশকিল।

বুড়িমা
ব্র‍্যান্ড 'বুড়ীমা'

শুরুর কথা


সালটা ১৯৪৮, দেশভাগের দগদগে ঘা আর একমাথা দুশ্চিন্তাকে বুকে জড়িয়ে দেশ ছাড়েন অন্নপূর্ণা। দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে তাঁর ঠাঁই হল পশ্চিম দিনাজপুরের গঙ্গারামপুরে রিফিউজি ক্যাম্পে। স্বামীকে চিরতরে হারিয়েছেন আগেই। গরিব বিধবার সম্বল বলতে সাহস আর অদম্য জেদ। ছেলে মেয়ে দুটোকে মানুষ করতে হবে যে!

গঙ্গারামপুরে বাজারে কিছুদিন সবজি বিক্রী এবং তারপর একজনের থেকে বিড়ি বাঁধা শিখলেন অন্নপূর্ণা। ছেলেমেয়েকে সঙ্গে নিয়েই বিড়ি বাঁধতে লাগলেন। একটু একটু করে মাথা গোজার একটা জায়গা হল, ছেলের পড়াশোনা, বরানগরে মেয়ের বিয়ে – তাও হল।


দিনাজপুর থেকে বেলুড়


১৯৫২-৫৩ সালে গঙ্গারামপুরের পাট চুকিয়ে বেলুড়ে ন’শো টাকায় একটা দোকান কিনলেন অন্নপূর্ণা, টালির একচালা দোকানের সাথেই ছোট্ট একটা থাকার ঘর। ছেলেকে দোকানে বসিয়ে চষে ফেলেন উত্তরপাড়া, সালকিয়া, বড়বাজার। কী ব্যবসা করবেন? কিসে হবে আরেকটু লাভ? সরস্বতীপুজোর আগে পিলখানার যোগেন্দ্র পালের কারখানা থেকে ঠেলাভর্তি করে প্রতিমা নিয়ে এলেন। তখন বেলুড়ে আর কোথাও ঠাকুর তৈরি হত না; কাজেই হাতের কাছে প্রতিমা পেয়ে সবাই ভীড় জমালো অন্নপূর্ণার দোকানে। এরপর দোলের আগে রঙের পসরা, লজেন্স, মণিহারি অনেক কিছুরই অস্থায়ী ব্যাবসা করলেন অন্নপূর্ণা। কিন্তু অন্যের জিনিস বিক্রী করে লাভ কোথায়? তাই অন্নপূর্ণার মন চাইছিল অন্য কিছু। এমন কিছুর ব্যাবসা যা হবে তার নিজের। কিন্তু কি সেই ব্যাবসা?

ছবি সৌজন্য - টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়া
বেলুড়ের সেই টালির বাড়ি ও দোকান

অন্নপূর্ণা হলেন ‘বুড়ীমা’


স্কুলের কাছাকাছি দোকান হওয়ায় বাচ্চা ছেলেমেয়েদের যাতায়াত দোকানে ছিলোই। তাদের মধ্যেই কেউ একদিন বলে বসল, “বুড়ীমা, লজেন্স দাও!” কী বলে ওরা? দোকানে রাখা আয়নাটা সামনে ধরলেন অন্নপূর্ণা। চুলে পাক, শরীরে বয়সের ছাপ। আশ্চর্যভাবে,‘বুড়িমা’ নামটা ছড়িয়ে পড়ল। ছিন্নমূল অন্নপূর্ণা সেই থেকে হয়ে গেলেন ‘বুড়িমা’।  

 

বুড়ীমার চকোলেট বোমার জন্মকথা


সামনে কালীপুজো। বুড়ীমার ইচ্ছে দোকানে বাজি তুলবেন। এদিকে হাতে টাকা-পয়সাও নেই। একশো টাকা ধার করে তিনি  বাজি কিনলেন, কিন্তু বিধি বাম। দোকান ভাঙল পুলিশ, কারণ বাজি বিক্রীর উপযুক্র লাইসেন্স নেই তার। সেসবের যে দরকার হয় বুড়ীমা সেটাও জানতেন না। এর ক’দিন পরেই এক দুপুরে ছেলেকে চমকে দিলেন, “এই দেখ বাজি বিক্রির লাইসেন্স। আর বাজি তৈরির অনুমতিপত্রও!”

লাইসেন্স তো হল। কিন্তু কে দেবে কম দামে বাজি? বাঁকড়ায় আলাপ আকবর আলির সঙ্গে। সেখান থেকে বাজি আসতে শুরু করল সাথেই হাতে ধরে শেখালেন— কাকে বলে সোরা, ব্যাটরা, গন্ধক কী রকম দেখতে ইত্যাদি। একসময়ের বিড়ি বাঁধায় সিদ্ধহস্ত বুড়ীমা বাজি তৈরী করতে শুরু করলেন নিজের হাতে। প্রথম মরশুমেই বাজিমাত। সব বিক্রি হয়ে গেল। আকবরের ফর্মুলাতেই তুমুল জনপ্রিয় হল ‘বুড়ীমার চকলেট বোম’। সেই পথ চলা শুরু।

দেখতে দেখতে ডানকুনি ও মধ্যমগ্রামে বুড়ীমার বাজির কারখানা তৈরী হল। কারখানার জন্য কিনলেও তালবান্দার জমি বুড়িমা বিলিয়ে দিয়েছিলেন গরিবদের। এক সময় যাঁর মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না, তিনিই পঞ্চাশটি পরিবারকে বাড়ি বানিয়ে দিলেন।  


Cracker
বুড়িমার বিখ্যাত চকলেট বোমা

শেষের সেই দিন


১৬/১ পিয়ারীমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের বিরাট বাড়ির সর্বত্র জুড়ে রয়েছেন ১৯৯৫ সালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করা বুড়ীমা। শোনা যায় তাঁর শেষ দিনে বাড়ির সামনে চকোলেট বোমা ফাটিয়ে তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন কিছু মানুষ।

ছেলে ও।নাতি
বুড়ীমার ছেলে সুমিত ও নাতি সুমন

এখন


২০২১ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গে শব্দবাজি নিষিদ্ধ হয়েছে, বুড়ীমার ছেলে সুমিত ও নাতি সুমনও আতস বাজিতে ঝুঁকেছেন পারিবারিক ব্যাবসা সামলাতে। ‘ছবির লাইনে’ও হাত পাকিয়েছেন তারা কিন্তু অন্নপূর্ণা দাস ওরফে ‘বুড়ীমা’ তার জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়ার রূপকথা সমেত আজও বাঙ্গালীর হৃদয়ে রয়ে গেছেন কালীপুজার অমাবস্যার রাতের মতই ভালো আর আলোর মিশ্রনে।   

Poster of 'Jomaloye Jibonto Bhanu'
'বুড়িমা চিত্রম' নিবেদিত ছবি 'যমালয়ে জীবন্ত ভানু'

Comments

Rated 0 out of 5 stars.
No ratings yet

Add a rating
bottom of page