প্যাট্রিক প্যাটারসন : The Forgotten Prince of Cricket
- Piyali Debnath

- Oct 29, 2024
- 3 min read
Updated: Oct 30, 2024
একবার শচীন টেন্ডুলকারকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো, আপনার খেলা বোলারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গতি কার ছিল, শোয়েব আখতার নাকি ব্রেট লি? না কি ম্যাকগ্রা? সবাইকে অবাক করে দিয়ে শচীন জানালেন, তার মুখোমুখি হওয়া সবচেয়ে গতিধর বোলার ‘প্যাট্রিক প্যাটারসন’! গুঞ্জন শুরু হল, কে এই প্যাট্রিক প্যাটারসন??? উপস্থিত অধিকাংশ সাংবাদিক নামটাই শুনলেন প্রথমবার।

৮০'র দশক ও ৯০'র দশকের প্রথমদিকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট টিমের উইকেট রক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন বর্তমান টিভি ধারাভাষ্যকার জেফ ডুজন। ক্রিকেট প্রেমীরা জানেন সেই সময়টা ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের স্বর্ণযুগ। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট দল তখন বিশ্বসেরা সব ফাস্ট বোলারদের মিলনমেলা। এন্ডি রবার্টস, জোয়েল গার্নার, মাইকেল হোল্ডিং, কলিন ক্রফট, ম্যালকম মার্শাল, কার্টলি এমব্রোস, কোর্টনি ওয়ালসের মতো ইতিহাস সেরা ফাস্ট বোলারদের বিপরীতে উইকেট সামলাতে হয়েছে জেফ ডুজনকে। ডুজনকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো, অসংখ্য ফাস্ট বোলারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গতি কার ছিল বলে মনে করেন? মার্শাল নন হোল্ডিং নন গার্নার নন, অবাক হলেও সত্যি জেফ ডুজনের মতেও শ্রেষ্ঠ ফাস্ট বোলার ছিলেন প্যাট্রিক প্যাটারসন!

শুধু শচীন কিংবা জেফ ডুজন নন, পাকিস্তানের কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান জাভেদ মিয়াদাদ, ভারতের প্রাক্তন অধিনায়ক আজহারউদ্দীন, অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন অধিনায়ক স্টিভ ওয়া এদের মতো ক্রিকেট রত্ন যারা প্যাটারসনের বলের সামনে ব্যাট হাতে দাঁড়িয়েছেন, তাদের প্রায় সকলেরই মত - প্যাটারসনের চেয়ে বেশী গতির ফাস্ট বোলার তারা দেখেননি।

কিন্তু কোথায় হারিয়ে গেলেন এই প্যাট্রিক প্যাটারসন? এখনকার গ্ল্যামারাস ক্রিকেট কেন তাকে ভুলে গেল? এইসব প্রশ্নের উত্তরের সন্ধানে ইন্টারনেটের অতলে ডুব দিয়েছিলাম আমরা। ১৯৮৬-১৯৯৩ সাল পর্যন্ত ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে ২৮ টি টেস্ট ও ৫৯ টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলা এই জ্যামাইকান গতিদানব হঠাৎ করেই যেন হারিয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৯৩ সালে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে দল থেকে বাদ পড়েন। তার পর বিস্ময়করভাবে তিনি যেন সাধারনের ভীড়ে বিলীন হয়ে যান। তার সেইসময়কার সতীর্থ বা পরিবারের সদস্য কেউ তার কোন খবর বলতে পারেন নি অনেকদিন। অনেকে ভেবেছিলেন, তিনি বেঁচে নেই। মাঝে একবার শোনা গেছিল,প্যাটারসন কোন এক পাগলা গারদে আছে। কিন্তু কোথায় তা জানা নেই। কেউ কেউ এমনও বলেছেন, হয়তো আমেরিকা চলে গেছেন তিনি।
১৯৮৮ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ বনাম অস্ট্রেলিয়ার এক টেস্ট ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার তরুণ অলরাউন্ডার মিডিয়াম পেসার ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটসম্যানদের পর পর ৪ টি বাউন্সার দিয়েছিলেন। কাজটা সেইসময়ের নিরিখে যথেষ্ট সাহসের ছিল, কারণ ওয়েস্ট ইন্ডিজ বাউন্সার দেয়া শুরু করলে অস্ট্রেলিয়ার মাঠে টেকাই সমস্যা। সেইদিনের সেই তরুন অলরাউন্ডার, পরে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের মহীরূহ হয়ে ওঠা স্টিভ ওয়ার এই ঘটনাটি ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম মুখোরোচক গল্প। কিন্তু এই ঘটনার পরের অংশটি আমরা অনেকেই জানিনা, যার নায়ক ছিলেন এই প্যাটারসন। সেদিন ছিল খেলার চতুর্থ দিন। স্টিভ ওয়-কাণ্ডে ক্ষুব্ধ প্যাটারসন রেগেমেগে সোজা অস্ট্রেলিয়ার ড্রেসিংরুমে হানা দেন। তিনি সেখানে গিয়ে সবাইকে হুমকি দিয়ে আসেন, ‘সবগুলোকে কাল মাঠের মধ্যে খুন করবো বাউন্সার দিয়ে’! হয়েছিলও তাই। প্যাটারসন একাই অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিং লাইন আপ শেষ করে দিয়েছিলেন। সেই ইনিংস-এ তার আগুনে বোলিংয়ের শিকার হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার পাঁচ ব্যাটার। ফলস্বরূপ সেই ম্যাচে অস্ট্রেলিয়া করুণভাবে পরাজিত হয়।
বরাবরই মাথা গরম পাগলাটে ধরণের ছিলেন প্যাটারসন। তুলনামূলক বেশি রান দিতেন, তবে মাত্র ৫১.০৯ স্ট্রাইক রেটে বোলিং করে গেছেন যা টেস্ট ক্রিকেটে এক কথায় unmatchable। ব্যাটারদের জন্য মূর্তিমান আতঙ্ক ছিলেন তিনি। কিন্তু শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে জাতীয় দল থেকে বহিষ্কৃত হবার পর সেই প্যাটারসন কেমন যেন অন্যরকম হয়ে গেলেন। ক্রিকেট খেলার সাথে আর সম্পর্ক রাখেন নি, সম্পর্ক রাখেন নি পরিবার কিংবা সমাজের সাথেও। স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেরিয়েছেন, কেউ তার খোঁজও নেয় নি। তার বৃদ্ধ বাবা-মা ও জানেন না তাদের ছেলে কোথায় আছেন, বা আদেও আছে নাকি নেই!! এমন প্রতিভাবান বোলারের এভাবে হারিয়ে যাওয়া সত্যিই দুঃখজনক।
অবশেষে অনেক খোঁজাখুজির পর জ্যামাইকার এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে ২০১৭ সালে তাকে খুজে পান Bharat Sundaresan(এক ভারতীয় সাংবাদিক)। কিন্তু কোথায় সেই গতিদানব প্যাটারসন?এ যে এক কঙ্কালসার বুড়ো! প্যাটারসন একা একটি ঘরের এক পরিত্যক্ত বাড়িতে কোনমতে বেঁচেবর্তে আছেন। পাগল হয়ে যান নি, তবে অনেকটাই স্মৃতিভ্রষ্ট। পেটের ভাত জোগাড়ের তাড়নায় হেন কাজ নেই তিনি করেন না। প্রথমে কথা বলতে আগ্রহী ছিলেন না। কিন্তু যখন শুনলেন ৬ বছর ধরে এই তরুণ সাংবাদিক তাকে খুঁজে চলেছেন, তখন কথা বলতে রাজি হলেন।

কিন্তু কেন এই স্বেচ্ছানির্বাসন? কিছু কিছু প্রশ্নের কোন উত্তর নেই একসময়ের ত্রাস-এর কাছে। প্যাটারসন প্রায় ভুলেই গেছেন তার সোনালী অতীত। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেই টেস্টের কথা তিনি আর মনে করতে পারেন না। শুধু এটুকু মনে করতে পারেন সেইসব অসাধারণ উত্তেজনা্র দিন ছিল। ক্ষমার সুরে উপস্থিত সাংবাদিককে বলেন, ২৫ বছর হয়ে গেছে ওসব আমি এখন আর ভালো মনে করতে পারিনা। এমনকি তিনি বিশ্বের সবচেয়ে গতিধর বোলার ছিলেন শুনে যেন অবাক হলেন। এসব কিছুই তার মনে নেই। তবে কথা বলতে বলতে কিছুটা মনে করার চেষ্টা করলেন। পাকিস্তানে গিয়ে জাভেদ মিয়াদাদকে আউট করেছিলেন, ভারত সফরে এসে বন্ধুত্ব হয়েছিলো আজহারউদ্দীনের সাথে। আজহারের কথা জিজ্ঞেস করলেন, ‘ও কি এখন কোচিং করায়?’ আজহারের ম্যাচ ফিক্সিং কেলেঙ্কারি ও রাজনীতিতে প্রবেশের কথা শুনে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান। টি টুয়েন্টি ক্রিকেট কি? খায় না মাথায় দেয়, এসব নিয়ে তার কোনও আইডিয়াই নেই। শচীন টেন্ডুলকারের কথা একটু একটু মনে আছে। তবে সে যে বিশ্বসেরা ব্যাটসম্যান হয়ে গেছে এসব কিছুই তিনি জানেন না।

প্যাট্রিক প্যাটারসন এমন এক সময় ক্রিকেট খেলেছেন যখন মাঠে স্পিড মিটার বসানো হতো না। হয়তো ১০০ মাইলের বেশি গতিতেই তিনি বোলিং করেছেন সেইসময়ে। আজ ক্রিকেট মিলিয়ন ডলারের খেলা। একসময় এই খেলায় তেমন টাকা ছিলনা। তবে ভাগ্যের ফেরে সোনার যৌবন দেশের জন্য উৎসর্গ করেও যাযাবরের মতো জ্যামাইকার প্রত্যন্ত অঞ্চলে শুধু দুবেলা খেয়ে পড়ে থাকার জন্য অদম্য লড়াই করতে হচ্ছে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ গতিদানবকে, যা ভাবলেই মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে।




_edited.jpg)

Comments